গত ২২ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্ধডজনবার থেকে ডজনখানেকবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার শীর্ষ পদে একজনকেই দেখে আসছে পুরো বিশ্ব। মাঝখানে চার বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন বাদে প্রায় দুই যুগ ধরে রাশিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভ্লাদিমির পুতিন। কঠোরভাবে রাজনৈতিক বিরোধী ও ভিন্নমত দমনে সক্ষম হলেও ইন্টারনেটের অবারিত দুনিয়ায় রাশিয়ানরা তাদের মত-ভিন্নমত জানানোর সুযোগ পাচ্ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইন্টারনেট দুনিয়া যেভাবে রাশিয়াকে অবরোধ করে রেখেছে, তাতে দেশটির জনগণ বিশ্ব থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হচ্ছে কি?
পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডিজিটাল অবরোধ আরোপ করে ইন্টারনেটভিত্তিক প্লাটফর্মগুলো। বহুজাতিক ইন্টারনেট কোম্পানির পাশাপাশি রুশ কর্তৃপক্ষও তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী দেয়াল তুলে দেয়। একসময় ইন্টারনেট যেখানে রাশিয়াকে বিশ্বসম্প্রদায়ে যুক্ত হওয়ার মাধ্যম ছিল, আজ তা বিচ্ছিন্নতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
রাশিয়ায় সেবা প্রত্যাহার করে নেয়া সর্বশেষ ইন্টারনেটভিত্তিক প্লাটফর্ম হচ্ছে টিকটক ও নেটফ্লিক্স। আংশিকভাবে ব্লক রয়েছে ফেসবুক ও টুইটার। গুগল মালিকানাধীন ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট ইউটিউবের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। অ্যাপল, স্যামসাং, মাইক্রোসফট, ওরাকল ও সিসকোর মতো কোম্পানি রাশিয়ায় কার্যক্রম স্থগিত করেছে কিংবা একেবারে গুটিয়ে নিয়েছে। এমনকি মাইনক্রাফটের মতো অনলাইন ভিডিও গেমসও রাশিয়ায় আর সক্রিয় নয়।
পশ্চিমা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর এ পদক্ষেপের ফলে চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মতো দেশের কাতারে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া। গত কয়েক বছরে পশ্চিমা ইন্টারনেট থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চীনের ইন্টারনেট জগৎ। ইরানে বিক্ষোভসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইন্টারনেট সংযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ইরান। ডিজিটাল দুনিয়া থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বাসই বড় আকারের ধাক্কা খেয়েছে। গণতন্ত্রের বিকাশ এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর উদারীকরণে প্রযুক্তি ভূমিকা রাখবে—এমনটাই মনে করে আসছিল তারা। কিন্তু ভিন্ন চিত্রই দেখা যাচ্ছে এখন। থিংকট্যাংক নিউ আমেরিকার সিনিয়র ফেলো ও ফেসবুকের সাবেক কাউন্টারটেররিজম পলিসি পরিচালক ব্রায়ান ফিশম্যান বলেন, উদার ও উন্মুক্ত ইন্টারনেটের ধারণা একসময় যেভাবে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল, বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ক্ষণে ক্ষণেই হোঁচট খাচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়া।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আগ্রাসনের পর আর্থিক বয়কটের পাশাপাশি ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাশিয়া। তবে এ ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা রুশ কর্তৃপক্ষের জন্য সুবিধাজনক বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। রুশ জনতাকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার কাজটি ক্রেমলিনের জন্য শাপেবর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা পুতিনের পক্ষে যাচ্ছে। বিরুদ্ধ মত দমন ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ সহজতর হয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহে নতুন একটি গণমাধ্যম আইন অনুমোদন করেন পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধসংক্রান্ত ভুয়া তথ্য প্রচারে সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম ও ওয়েবসাইটের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে ওই আইনে। লন্ডনভিত্তিক সংস্থা নেটব্লকসের পরিচালক আলপ টোকার জানান, রাশিয়া যেন হঠাৎ করে ফের আশির দশকে ফিরে গিয়েছে যখন তথ্যপ্রবাহের পুরো নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে।
ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া লোকোট বলেন, এক দশক ধরেই রাশিয়ায় ইন্টারনেট সেন্সরশিপ জোরদার হচ্ছে। প্রথমে সরকারের সমালোচকদের একহাত দেখে নেন পুতিন, তারপর অনলাইনে স্বাধীন সংবাদ প্লাটফর্মগুলোর টুঁটি চেপে ধরেন। তখন থেকে বিভিন্ন সময়ে টুইটার ও ফেসবুকের মতো সাইট ব্লক বা স্লো করে দেয়ার কৌশল নেয় ক্রেমলিন। এতে সর্বশেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে ইউক্রেন আগ্রাসন এবং তত্পরবর্তী ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা। নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে।
The post রাশিয়া কি তবে ডিজিটাল দুনিয়া থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হলো? appeared first on Techzoom.TV.
0 Comments