বিটিসিএলের প্রকল্পে হুয়াওয়ের দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) প্রায় ৩২৬ কোটি টাকার ‘ফাইভজি রেডিনেস’ প্রকল্পে চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়েকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি ক্রয় নীতিমালা (সিপিটিইউ) লঙ্ঘন করে নজিরবিহীন দ্রুতগতিতে হুয়াওয়েকে এই প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল।

এই প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে দুদক সক্রিয় অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এর মধ্যেই ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থছাড়ের জন্য দুদককে ‘তদবির’ বা সুপারিশ জানিয়ে চিঠি দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

যেভাবে দুর্নীতির শুরু
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গৃহীত এই প্রকল্পটি শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল। অভিযোগ অনুযায়ী, তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী প্রকল্পের টেন্ডার বাতিল করে নতুন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিলেও, তৎকালীন সচিব সেই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেন। তিনি মাত্র একদিনের নোটিশে বিটিসিএলের বোর্ড সভা ডেকে একই দিনে আর্থিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করে হুয়াওয়েকে কার্যাদেশ দেন। সরকারি দপ্তরের স্বাভাবিক গতির তুলনায় এই প্রক্রিয়াকে “অবিশ্বাস্য” বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জমা দেওয়া সেই কমিটির প্রতিবেদনেও সাবেক সচিবের বিরুদ্ধে সরাসরি গুরুতর ও নজিরবিহীন অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের তদবির ও দুদকের কঠোর অবস্থান
দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে এই প্রকল্পের অর্থছাড়ের জন্য দুদককে চিঠি দিয়ে সহায়তা চাওয়া হয়। জবাবে দুদক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, প্রকল্পে দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় তদন্ত চলাকালে অর্থছাড় করা আইনসিদ্ধ হবে না।

এর পরপরই গত ২২ জুন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব দুদককে একটি আধা-সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়ে অর্থছাড়ে “সহযোগিতা” কামনা করেন। দেশের “বৃহত্তর স্বার্থ” এবং প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়া রোধ করার যুক্তি দেখিয়ে তিনি এই তদবির করেন।

দুদকের কঠোর অবস্থানের পর মন্ত্রণালয়ের এই ধরনের চিঠি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাজে হস্তক্ষেপের চেষ্টা কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমানে দুদকের তদন্ত এবং মন্ত্রণালয়ের অর্থছাড়ের চেষ্টার এই দ্বিমুখী অবস্থানে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

প্রকল্পটি কারিগরিভাবেও ‘অবাস্তব ও অর্থহীন’
দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি প্রকল্পটি কারিগরি দিক থেকেও অবাস্তব ও অর্থহীন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিসিএলের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী দশকে দেশে ফাইভজি চালু হলে ডেটার ব্যবহার সর্বোচ্চ ২৬ টেরাবাইটে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু এই প্রকল্পে ১২৬ টেরাবাইট ধারণক্ষমতা এবং ১২ বছরের রক্ষণাবেক্ষণের সময় ধরা হয়েছে, যা প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের যুগে একেবারেই অবাস্তব।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি মোবাইল অপারেটরদের নিজস্ব ডিডব্লিউডিএম (DWDM) সরঞ্জাম কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে বিটিসিএলের এই প্রকল্পের সেবা নেওয়ার কোনো প্রয়োজন তাদের থাকবে না। এর ফলে, বিশাল অঙ্কের এই প্রকল্পটি কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়বে।

The post বিটিসিএলের প্রকল্পে হুয়াওয়ের দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক appeared first on Techzoom.TV.

Post a Comment

0 Comments