বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্প: দরপত্র থেকে আমদানি, পরতে পরতে দুর্নীতির অভিযোগ

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ‘ফাইভ-জি রেডিনেস’ প্রকল্পটি শুরু থেকেই অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত। সাবেক সরকারের আমলে একটি প্রশ্নবিদ্ধ দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে দেওয়া ৩২৬ কোটি টাকার কার্যাদেশটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর স্থগিত করে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু সেই তদন্তকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকারেরই একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তড়িঘড়ি করে সেই সরঞ্জাম আমদানির জন্য নজিরবিহীন তৎপরতা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, যা পুরো প্রকল্পটিকে একটি জটিল আইনি ও আর্থিক সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

এই ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী-সচিব থেকে শুরু করে বর্তমান সরকারের বিশেষ সহকারী এবং বিটিআরসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।

যেভাবে শুরু: ত্রুটিপূর্ণ দরপত্র ও সৎ কর্মকর্তাকে অপসারণ

২০২২ সালে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। এর আওতায় ৪৬৩ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে গুরুতর কিছু অনিয়ম ঘটে:

  • অযোগ্যকে যোগ্যতা দান: দরপত্রের কারিগরি শর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও হুয়াওয়ে, জেডটিই এবং নোকিয়া—সবাইকে কারিগরিভাবে যোগ্য ঘোষণা করা হয়, যা সরকারি ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর) এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
  • সন্দেহজনক তাড়াহুড়ো: মাত্র দুই দিনের নোটিশে আর্থিক দরপত্র খোলা হয় এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র দুই কার্যদিবসে মূল্যায়ন শেষ করে হুয়াওয়েকে কাজ দেওয়া হয়।
  • অর্থ অপচয়ের অভিযোগ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমীক্ষা লঙ্ঘন করে প্রয়োজনের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

তৎকালীন বিটিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আসাদুজ্জামান চৌধুরী এই অনিয়মগুলো চিহ্নিত করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এর পরপরই তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের চাপের মুখে পড়েন তিনি। অনিয়মের পক্ষে সায় না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে পদ থেকে অপসারণ করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দেওয়া হয় এবং নতুন এমডি নিয়োগ দিয়ে হুয়াওয়েকেই কাজটি দেওয়া হয়।

তদন্তের মুখে নতুন তৎপরতা: বিশেষ সহকারীর ভূমিকা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এই প্রকল্পের কেনাকাটা স্থগিত করে দুদককে তদন্তের নির্দেশ দেন। দুদক গত ৯ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করে।

কিন্তু মার্চ মাসে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রকল্পটি পুনরায় চালু করতে তৎপর হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ:

  • দুদককে প্রভাবিত করার চেষ্টা: তিনি দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন এবং কেনাকাটা এগিয়ে নিতে ‘সহযোগিতা’ চেয়ে একাধিকবার চিঠি দেন। দুদক উত্তরে জানায়, প্রাথমিক অনুসন্ধানে আইনের লঙ্ঘন পাওয়ায় এ অবস্থায় কেনাকাটা আইনসিদ্ধ হবে না।
  • বাধ্যতামূলক পরীক্ষা এড়ানোর কৌশল: নিয়ম অনুযায়ী, সরঞ্জাম আমদানির আগে চীনে হুয়াওয়ের কারখানায় গিয়ে তা পরীক্ষা (ফ্যাক্টরি প্রি-অ্যাকসেপ্টেন্স টেস্ট বা FPAT) করার কথা। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে সেই পরীক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন।

আইন লঙ্ঘন করে সরঞ্জাম আমদানি

বিশেষ সহকারীর নির্দেশনার সুযোগ নিয়ে এবং কারখানা পরিদর্শন ছাড়াই হুয়াওয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে সরঞ্জাম পাঠিয়ে দেয়। গত ১৬ জুন, ২০২৫ তারিখে তারা বিটিসিএলকে জানায়, সরঞ্জাম চট্টগ্রাম বন্দরের পথে রয়েছে। এই ঘটনায় বিটিসিএল এখন মহাসংকটে।

  • আইনি সংকট: দুদক যে প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলছে, সেই প্রক্রিয়ায় আমদানি করা সরঞ্জাম গ্রহণ করলে বিটিসিএল আইনত দায়ী হবে।
  • আর্থিক সংকট: সরঞ্জাম গ্রহণ না করলে হুয়াওয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে পারে। আবার, সরঞ্জাম গ্রহণ করলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থ ছাড় করতে নারাজ, কারণ আমদানির প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ।

এই ঘটনায় বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকল্পকে বাঁচানোর জন্য বর্তমান সরকারের একজন কর্মকর্তা কেন এত তৎপর? দুদককে পাশ কাটিয়ে কার স্বার্থে এই সরঞ্জাম আমদানির তড়িঘড়ি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই বলে দেবে, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটনে নতুন সরকার আসলে কতটা আন্তরিক।

The post বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্প: দরপত্র থেকে আমদানি, পরতে পরতে দুর্নীতির অভিযোগ appeared first on Techzoom.TV.

Post a Comment

0 Comments