হাজার কোটি টাকার ব্যবসা, তবু কেন ডুবল ফ্লাইট এক্সপার্ট?

গত বছরও যারা দেশের অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) বাজারের অবিসংবাদিত শীর্ষে ছিল, সেই ফ্লাইট এক্সপার্টের আকস্মিক পতন নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো ভ্রমণ শিল্পকে। ২০২৪ সালে প্রায় এক হাজার ৮৬ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করা একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে কয়েকশ কোটি টাকার দায় নিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারে, সেই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। এটি কি সাধারণ প্রতারণা, নাকি ভুল ব্যবসায়িক মডেল ও অভ্যন্তরীণ সংকটের করুণ পরিণতি?

ইন্ডাস্ট্রির ভেতরকার নানা তথ্য ও বিশ্লেষণ এই পতনের পেছনে একটি জটিল আর্থিক সংকট এবং ব্যবস্থাপনার ত্রুটির চিত্র তুলে ধরেছে।

বিশাল অংকের লেনদেন, ভেতরে ফাঁপা?
ফ্লাইট এক্সপার্টের ব্যবসায়িক মডেল ছিল গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে টিকিট বুকিং দেওয়া। কিন্তু তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ (ক্যাশ বার্ন) অনেক বেশি ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। মূলত, নতুন গ্রাহকের টাকা দিয়ে পুরোনো গ্রাহকের টিকিট ও প্রাতিষ্ঠানিক খরচ মেটানোর একটি ঝুঁকিপূর্ণ চক্রে প্রবেশ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। যখনই নতুন অর্থের প্রবাহ কমে আসে, তখনই এই মডেলটি ভেঙে পড়ে।

আইএটিএ, ব্যাংক গ্যারান্টি ও ঋণের জাল
এই পতনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আইএটিএ (ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন) সংস্থাগুলোর সঙ্গে ফ্লাইট এক্সপার্টের আর্থিক সম্পর্কের অবনতি।

মূল আইএটিএ সংকট: ফ্লাইট এক্সপার্টের প্রধান আইএটিএ পার্টনার ছিল ‘মক্কা ট্রাভেলস’, যাদের ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু এই ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক করাপ্টেড বা খেলাপি হয়ে পড়ে বলে জানা যায়। এর ফলে ফ্লাইট এক্সপার্টের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

অন্যান্য সংস্থার পাওনা: মক্কা ট্রাভেলস ছাড়াও হাজী এয়ার ট্রাভেলস ও সুমা ট্রাভেলসের মতো বড় আইএটিএ সংস্থাগুলোর কাছেও ফ্লাইট এক্সপার্টের কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়েছিল। এই পাওনাদার সংস্থাগুলো এখন তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ফ্লাইট এক্সপার্টের গ্রাহকদের প্রাপ্য রিফান্ডের টাকা আটকে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তবে এই সংকটের মধ্যে ‘হাজী এয়ার ট্রাভেলস’ ক্ষতিগ্রস্ত এজেন্সিগুলোকে একটি সুযোগ দিয়েছে। এজেন্সিগুলো তাদের রিফান্ডের টাকা হাজী এয়ারকে দিয়ে নতুন টিকিট ইস্যু করে নিজেদের ব্যবসা চালু রাখতে পারছে, যা এই শিল্পে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে।

পতনের নেপথ্যে সম্ভাব্য কারণ
ফ্লাইট এক্সপার্টের পতনের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির ভেতরে আলোচনা চলছে:

১. অতিরিক্ত ক্যাশ বার্ন: বাজার দখলের জন্য অতিরিক্ত ছাড় এবং আক্রমণাত্মক বিপণন নীতির কারণে তাদের ব্যয় আয়কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২. অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের মধ্যে ব্যবসায়িক কৌশল এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তীব্র মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল বলে শোনা যায়।
৩. ব্যর্থ বিনিয়োগ চুক্তি: জাপানের একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অংকের বিনিয়োগ পাওয়ার কথা ছিল ফ্লাইট এক্সপার্টের। ধারণা করা হচ্ছে, সেই চুক্তিটি চূড়ান্ত মুহূর্তে ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি নগদ টাকার তীব্র সংকটে পড়ে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

‘বিলিয়ন ডলার’ স্বপ্নের আকস্মিক মৃত্যু
একটি বিলিয়ন ডলার কোম্পানি হওয়ার স্বপ্ন দেখা ফ্লাইট এক্সপার্টের হঠাৎ করে ব্যবসা গুটিয়ে দেশ ছাড়াটা নিছক প্রতারণার চেয়েও বড় কিছু। এটি মূলত একটি আক্রমণাত্মক কিন্তু টেকসই নয় এমন ব্যবসায়িক মডেলের পতনের উদাহরণ। পাওনাদারদের চাপ, ব্যাংকের ঋণ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না পাওয়া—এই সবগুলো কারণ একত্রে একটি ‘ডমিনো ইফেক্ট’ তৈরি করে, যার শেষ পরিণতি এই আকস্মিক পতন।

এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তদন্তেই হয়তো বেরিয়ে আসবে আসল সত্য। তবে তার আগ পর্যন্ত ফ্লাইট এক্সপার্টের এই পতন দেশের স্টার্টআপ জগত এবং গ্রাহকদের জন্য একটি বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে।

The post হাজার কোটি টাকার ব্যবসা, তবু কেন ডুবল ফ্লাইট এক্সপার্ট? appeared first on Techzoom.TV.

Post a Comment

0 Comments