‘চোরদের’ মতামত ছাড়াই এনইআইআর চালু: অবৈধ ফোন সিন্ডিকেটের ‘উদ্বেগ’

দেশে অপরাধ দমন, হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ন্যাশনাল ইকুইলমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (NEIR) ব্যবস্থা চালুর চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এই সিস্টেমের মূল উদ্দেশ্য অবৈধ, ক্লোন ও চোরাই পথে আসা মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ অচল করে দেওয়া।

কিন্তু সরকারের এই মহৎ উদ্যোগটি বাস্তবায়নের মুখেই এক অদ্ভুত বাধার সম্মুখীন হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, “মোবাইল বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠন, যা মূলত অবৈধ ও চোরাই ফোন বিক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষা করে, তারা এই প্রক্রিয়ায় মতামত না রাখায় ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে।

বিশ্লেষকরা এই ঘটনাকে তীব্র কটাক্ষ করে বলছেন, বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে, “চোরের দলকে” জিজ্ঞাসা করা হয়নি কীভাবে চুরির পথ বন্ধ করা হবে, এবং এতেই তারা অখুশি।

সাবেক সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সিন্ডিকেট?

এই প্রতিরোধের চেষ্টার মধ্যেই বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। অভিযোগ উঠেছে, অবৈধ ফোন ব্যবসায়ী এই চক্রের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের।

এই সিন্ডিকেটের শেকড় কতোটা গভীরে ছিল, তার প্রমাণ মেলে তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের একটি বক্তব্যে। তিনি গণমাধ্যমকে সরাসরি জানিয়েছিলেন, “সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশে আমরা অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধের যে সিস্টেম ডেভেলপ করেছিলাম, সেটা চালু করবো না।”

সাবেক সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সরাসরি এই সিস্টেম বন্ধের নির্দেশ আসায়, হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া এবং অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য বানানো এই ‘গ্রে মার্কেট’ বন্ধের কোনো উদ্যোগ অতীতে সফল হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে যে, সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ এর সাথে শেয়ার দিয়ে ব্যবসা করছে দেশের বেশ কিছু জনপ্রিয় গ্যাজেট শপ। সালমান এফ রহমান, তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান এবং আরও কিছু ব্যবসায়ীকে নিয়ে অবৈধ মোবাইল ফোনের এক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।

অবৈধ বাজারের দাপট

“মোবাইল বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ” নামের এই সংগঠনটির দাবি, দেশের মোবাইল বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশই বর্তমানে অবৈধ ফোন বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে।

যদিও মোবাইল ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (MIOB) জানিয়েছে, দেশের বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ এই ‘গ্রে মার্কেট’ দখল করে আছে। এই অবৈধ বাণিজ্যের কারণেই দেশীয় উৎপাদন শিল্প ধ্বংসের মুখে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ এবং শুধু জুন মাসেই এই পতন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ, স্থানীয় কারখানাগুলোই দেশের ৯৯ শতাংশ চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা রাখে।

আরও পড়ুন: অবৈধ পথে মোবাইলফোনে কোটি কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি ৪ মোবাইল শপের

বাজার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খোদ রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের বড় বড় শোরুমে প্রকাশ্যেই চলছে আনঅফিসিয়াল হ্যান্ডসেট বিক্রি। অ্যাপল, স্যামসাং, মটোরোলার মতো ব্র্যান্ডের হাই-এন্ড মডেলগুলো ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কম দামে বিক্রি হওয়ায় ক্রেতারাও সেদিকে ঝুঁকছেন।

অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ হ্যান্ডসেটের এই বাজারে অ্যাপল গেজেট, এসএমএম গেজেট, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার, রিও ইন্টারনেশনাল, ড্যাজেল মোবাইল শপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দাপট সবথেকে বেশি।

বর্তমান সরকারকে ‘অস্থিতিশীল’ করার হুমকি?

অবৈধ ফোন ব্যবসায়ীরা এখন অভিযোগ করছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাংশ ও কিছু আমলাকে ‘বিভ্রান্ত’ করে নির্বাচনের আগে এমন একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অস্থিতিশীল করতে পারে।”

তাদের দাবি, দেশের ৯৫ শতাংশ সাধারণ ব্যবসায়ী কর দিতে ইচ্ছুক, কিন্তু বাকি ৫ শতাংশ মুনাফালোভী সিন্ডিকেট সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে।

আরও পড়ুন: অবৈধ মোবাইলফোন

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই “উদ্বেগ” প্রকাশ ও “অস্থিতিশীল” করার হুমকি— দুটোই আসলে এনইআইআর (NEIR) সিস্টেমকে বন্ধ করার জন্য অতীতের মতো নতুন অপচেষ্টা। সরকার এই সিস্টেমটি তৈরি করেছে দুটি প্রধান কারণে: অপরাধ দমন (অনলাইন জুয়া, আর্থিক জালিয়াতি) এবং হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বৃদ্ধি। এই সিন্ডিকেটকে ভেঙে বর্তমান সরকার এই রাষ্ট্রীয় সংস্কারটি বাস্তবায়ন করতে পারে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

The post ‘চোরদের’ মতামত ছাড়াই এনইআইআর চালু: অবৈধ ফোন সিন্ডিকেটের ‘উদ্বেগ’ appeared first on Techzoom.TV.

Post a Comment

0 Comments